জামদানির জাদু
‘আমি আনতে পারি আলতা, চুরি, ঢাকাই শাড়ি, গহনা; চাই কী তোমার বুঝিয়ে বলো না।’ ঢাকার কয়েকটি অঞ্চলে তৈরি জামদানি মোটিফে বোনা শাড়িই ঢাকাই শাড়ি নামে পরিচিত, যা আধুনিক কালে জামদানি শাড়ি নামে পরিচিতি লাভ করে। প্রতিবেদনের প্রথম লাইনটি বাংলা চলচ্চিত্র সুতরাং-এর জনপ্রিয় একটি গান থেকে নেওয়া। গানটি ষাটের দশকের হলেও ঢাকাই বা জামদানি শাড়ির আবেদন মেয়েদের কাছে আজও অমলিন। এটাই জামদানির ‘জাদু’। এর বুননশৈলী ও সৌন্দর্য নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। এর সঙ্গে বাঙালির ঐতিহ্য বা সংস্কৃতির সম্পর্ক আদিকালের।
বাঙালির গর্বের মাস, বিজয়ের মাস ডিসেম্বরেই জাতির জন্য আরও একটি বড় অর্জন আছে, যার সঙ্গে এই বুনন শিল্পরীতি জড়িত। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ইউনেসকোর পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে জামদানির মেধা স্বত্বের (ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি) স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ইউনেসকো কমিশনের অষ্টম অধিবেশনে ‘কনভেনশন ফর দ্য সেফগার্ডিং অব দ্য ইন্ট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ’ বিষয়ে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়। বিজয়ের মাসে এমন একটি স্বীকৃতি পাওয়া নিঃসন্দেহে গৌরবের। দেশীয় কোনো অনুষ্ঠান হোক কিংবা আন্তর্জাতিক—বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে এমন পোশাকের কথা ভাবতে গেলে সবার আগে জামদানির কথাই মনে পড়ে।
অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী দেশীয় পোশাক পরতেই বেশি ভালোবাসেন, তাঁর পছন্দের তালিকায় শীর্ষে আছে জামদানি শাড়ি, তাই বেশির ভাগ অনুষ্ঠানে জামদানিতেই দেখা যায় তাঁকে। ‘আর কোনো পোশাক বাংলাদেশকে সেভাবে তুলে ধরতে পারে না, যেটি জামদানি পারে। এর সঙ্গে আমাদের ঐতিহ্য ও কৃষ্টি জড়িত। এ ছাড়া ফ্যাশন বা আকর্ষণের কথা যদি বলি, তাহলেও আমার কাছে জামদানির ওপরে আর কিছু নেই। আমার মনে হয়, একজন বাঙালির জন্য এর চেয়ে অভিজাত পোশাক আর কিছু হতেই পারে না।’ এভাবেই জামদানির প্রতি নিজের ভালোলাগার কথা জানালেন রোকেয়া প্রাচী। ২০০৩ সালে যখন কান চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন, তখনো তাঁর পরনে ছিল জামদানি। উৎসবের বিশেষ অনুষ্ঠানগুলোতে একেক দিন একেক রঙের জামদানি পরেছিলেন বলে জানালেন।
এখন কী ধরনের জামদানি চলছে? প্রশ্নটি শুনে টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের স্বত্বাধিকারী মুনিরা ইমদাদ বললেন, ‘জামদানিতে এখন এক রং বা দুই রঙের সমন্বয়ই বেশি চলছে। জরির কাজ থাকলে তা বিয়ে বা জমকালো কোনো দাওয়াতে পরা যেতে পারে, আবার পুরোটা কেবল সুতা দিয়ে তৈরি হলে তার সৌন্দর্যও আরেক রকম। এখন ছাই রং, বিস্কুট রং, চাপা সাদা, বেবি পিংক, পেস্তা, ফিরোজার মতো হালকা রঙের জামদানিও মানুষ বেশ পছন্দ করছেন।’
মাঝে একটা সময় জামদানিতে এপ্লিক বা লেসের ব্যবহার করে নিরীক্ষার চেষ্টা করা হয়েছিল, সেটা অবশ্য খুব বেশি দিন চলেনি। বুননশিল্পী বা পৃষ্ঠপোষক কেউই যে জামদানির নকশায় নতুন কিছু যুক্ত করার পক্ষে নন, তা তাঁদের বক্তব্যেই স্পষ্ট। মুনিরা ইমদাদের মতে, ‘ঈশ্বর যদি কাউকে খুব সুন্দর চুল দেন, তাঁর তো পরচুলা পরার কোনো দরকার নেই। জামদানিতে যেকোনো “ভ্যালু অ্যাড” করার চেষ্টা রীতিমতো অনৈতিক।’
আসলেই তো, যা এমনিতেই এত সমৃদ্ধ, তার ওপর নতুন করে মূল্য যোগ করার আর কী আছে? অবশ্য যুগের সঙ্গে সঙ্গে জামদানির নকশায় হালকা কিছু পরিবর্তন এসেছে, তবে জামদানির আসল চেহারা হারায়নি, পাল্টায়নি এর বুননকৌশলও। যেমন প্রাচীন আমলে ফুলেল মোটিফের নকশা বেশি দেখা যেত, এরপর কানবালা, ছোট বুটি, বরফি—নানা রকম মোটিফ এতে যুক্ত হয়েছে।
ব্র্যাকের জ্যেষ্ঠ পরিচালক, এন্টারপ্রাইজেস তামারা হাসান আবেদ বললেন, ‘বর্তমানে জামদানিতে আদি মোটিফগুলোই ব্যবহার করা হচ্ছে। এর সঙ্গে খুবই সামান্যই ভিন্ন মোটিফ ব্যবহৃত হয়, যা জামদানির ঐতিহ্যবাহী মোটিফের ভিন্ন মাত্রা। রংয়ের মধ্যে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে হালকা রং, যেমন লাইট পিচ, লাইট পিংক, ক্রিম, বেজ, প্যাস্টেল শেড ইত্যাদি। আর অফ হোয়াইট শাড়ির চাহিদা তো সব সময় ছিল এবং আছে। তবে সময় অনুযায়ী শাড়ির কিছু রং পরিবর্তন হয়, যেমন শীতে গাঢ় রং, গরমের সময় হালকা রং, বৈশাখে লাল, সাদা ইত্যাদি।’ বর্তমানে বহুরঙা শাড়ির চল একদম নেই বললেই চলে। ক্রেতারা এখন এক রঙের বা টোনাল শাড়ি বেশি পছন্দ করছেন বলেই জানালেন তিনি।
আড়ং-এর জামদানি কালেকশন সম্পর্কে তামারা জানালেন, আমরা জামদানির ঐতিহ্য এবং ক্রেতার রুচি বা চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়েছি। জামদানি শাড়ির নান্দনিকতাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আড়ংয়ের সংগ্রহে। তিনি বলেন, ‘২০১০-এর স্টোরি অব প্রাইড নামক প্রদর্শনীর মাধ্যমে আমরা প্রথম বাংলাদেশে দামি শাড়ির প্রচলন করে থাকি। এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে আমরা হাই কাউন্ট সুতার শাড়ি বুনে থাকি। আর আমরা তরুণ প্রজন্মকে জামদানি শাড়ি পরতে অনুপ্রাণিত করি।’
অনেক আগে থেকেই জামদানি তৈরির জন্য শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ের পুরোনো সোনারগাঁ বিখ্যাত। রূপগঞ্জ, সোনারগাঁ ও সিদ্ধিরগঞ্জের প্রায় ১৫৫টি গ্রামে এ শিল্প এখনো চালু রয়েছে বলে জানালেন তামারা আবেদ।
শত বছরের ধারাবাহিকতায় স্বকীয়তা বজায় রেখে বাংলার ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে জামদানি।
একটা সময় বহু রঙের সুতার ব্যবহারে তৈরি জামদানি বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এখন আবার এর চল কমে গিয়ে এক রং বা দুটি বিপরীত রঙের সমন্বয়ে তৈরি জামদানি চলছে। রাসায়নিক রঙের পাশাপাশি ভেষজ রঙেরও ব্যবহার হচ্ছে জামদানিতে। একসময় কেবল শাড়ি ও উত্তরীয়তেই জামদানি নকশার কাজ হতো, এখন তরুণীদের কাছে জামদানির সালোয়ার-কামিজেরও কদর আছে। বললেন কুমুদিনীর হস্তশিল্প বিভাগের ব্যবস্থাপক সুখু বড়ুয়া।
বুননশিল্পীদের অবদান অনস্বীকার্য
২০১৩ সালের ২ থেকে ৭ ডিসেম্বর আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে ইউনেসকোর অষ্টম আন্তসরকার অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনেই জামদানির মেধাস্বত্ব পায় বাংলাদেশ। এ ব্যাপারে বাংলা ক্র্যাফটের সাবেক সভাপতি মালেকা খান জানান, এর আগে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে ফ্রান্সে বাংলােদশের রাষ্ট্রদূত ও ইউনেসকোতে স্থায়ী প্রতিনিধি শহিদুল ইসলাম এবং বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের নেতৃত্বে একটি দল গঠন করা হয়। দলটিকে জামদানির মেধাস্বত্ব চেয়ে মনোনয়ন নথি প্রস্তুত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ৪ ডিসেম্বর সেই সভায় আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের ঐতিহ্যবাহী জামদানিশিল্পের মেধাস্বত্ব অর্জন করি।’
মালেকা খানের মতে, অর্জন যে সময়েই হোক, তা নিঃসন্দেহে আনন্দের। তবে ডিসেম্বর মাসের সঙ্গে আমাদের এমন এক বিজয়গাথা জড়িত যে এ সময় যেকোনো অর্জনে আনন্দের মাত্রা যেন দ্বিগুণ হয়ে ধরা দেয়; তা সে যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন। বিজয়ের মাসে জামদানির মেধাস্বত্বের স্বীকৃতি পাওয়া আমাদের অর্জনের আনন্দকে তাই আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এর কৃতিত্ব তাঁদের, যাঁরা জামদানির নকশা ও বুননের সঙ্গে বংশপরম্পরায় যুক্ত। যেসব বুননশিল্পী যুগ যুগ ধরে এর বুননকৌশলে অসাধারণ সৃজনশীলতা ধরে রেখেছেন, তাঁদের সবাইকে জানাই অভিবাদন। এর পেছনে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। এ ছাড়া জামদানিকে সবার কাছে পৌঁছে দিতে যাঁরা অক্লান্ত কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁদেরও ধন্যবাদ। এখন আমাদের সবার দায়িত্ব হলো এই অনিন্দ্য বুননশিল্পকে সুরক্ষা করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা।’
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব আকতারী মমতাজের কাছ থেকে জানা গেল, ২০০৩ সালে ইউনেসকো সারা বিশ্বের বিপন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুরক্ষার একটি উদ্যোগ নেয়। এই উদ্যোগে বাংলাদেশেরও সম্মতি ছিল। আকতারী মমতাজ বললেন, ‘২০১৩ সালে ইউনেসকোর এই সম্মেলনে জামদানিকে বিশ্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর আগে সেখানে মনোনয়নপত্র উপস্থাপনের জন্য জামদানি বিষয়ে প্রচুর তথ্য জোগাড় করতে হয়ছে। অনেক গবেষণা, পরিশ্রম ও যুক্তি উপস্থাপন করে তবেই আমরা জামদানির মেধাস্বত্বের স্বীকৃতি অর্জন করতে পেরেছি। এটি আমাদের জন্য একটি গৌরবের বিষয়। এখন পর্যন্ত আমরা বাংলাদেশ থেকে বাউলগান আর জামদানির মেধাস্বত্বের স্বীকৃতি পেয়েছি।’