রংপুরের শতরঞ্জি রপ্তানি হচ্ছে 80 দেশে
রংপুরের হারিয়ে যাওয়া ‘শতরঞ্জি’ জেগে উঠেছে। ফিরে পেয়েছে পুরোনো ঐতিহ্য। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে কয়েক হাজার নারী-পুরুষ কাজ করছেন। তাঁরা স্বাবলম্বী হয়েছেন। তৈরি করছেন নকশাখচিত শতরঞ্জি। এই শতরঞ্জি এখন বিশ্বের ৩৬টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। হস্তজাতশিল্প থেকে বছরে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে প্রায় ৪০ লাখ মার্কিন ডলার।
এই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও শতরঞ্জিশিল্পকে জাগিয়ে তুলতে রংপুরের কারুপণ্যের স্বত্বাধিকারী সফিকুল আলমের অবদানই প্রধান। তিনি ১৯৯১ সালে রংপুরে কারুপণ্য নামের একটি দোকান দিয়ে ঐতিহ্যবাহী হারিয়ে যাওয়া শতরঞ্জি বুননের কাজ শুরু করেন। জাগিয়ে তোলেন শতরঞ্জি।
হারিয়ে যাওয়া শতরঞ্জিশিল্পের সঙ্গে বর্তমানে সফিকুলের প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন পাঁচ হাজারের অধিক শ্রমিক। এই কাজ শুরু করতে গিয়ে সেই সময়ে ২০ জন কারিগরকে খুঁজে বের করেন তিনি। পুরোনো কারিগর ও নতুনদের প্রশিক্ষণ দিয়ে শতরঞ্জি বুননের কাজ শুরু করা হয়। গড়ে তোলেন কারুপণ্য নামের একটি দোকান। লোকজনের অর্ডার পেয়ে কারিগরদের দিয়ে শতরঞ্জি সরবরাহ করতে থাকেন। এতে সামান্য আয় হয়। ভাবলেন, এখানেই থেমে থাকলে চলবে না। শতরঞ্জি বিক্রির জন্য ব্যাপক প্রচারণায় নামলেন। সাড়াও পেলেন। শতরঞ্জি বানিয়ে দেশের বিভিন্ন শিল্প ও বাণিজ্য মেলায় স্টল দেন। শতরঞ্জির চাহিদা বাড়তে থাকে। পরবর্তী সময়ে ঢাকায় ‘শতরঞ্জি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। এখানেই শেষ নয়। শতরঞ্জির বাজার তৈরির জন্য বিদেশি ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে তিনি হন্যে হয়ে ঘুরতে থাকেন। ২০০২ সালে প্রথম জাপানে শতরঞ্জি রপ্তানির সুযোগ পান। সেখান থেকে আয় করেন ২০ হাজার ডলার।
শুধু জাপান নয়, এই পণ্য বিশ্বের আরও অনেক দেশে রপ্তানি হতে পারে। সফিকুল ভাবলেন, হস্তশিল্প ‘শতরঞ্জি’ তৈরির কারখানা গড়ে তুলবেন। নিসবেতগঞ্জ গ্রামে বিসিকের বন্ধ থাকা একটি দোচালা ছোট্ট কারখানাও ভাড়া নেন। ব্যবসা বাড়তে থাকে। প্রতিষ্ঠানের নাম দিলেন ‘কারুপণ্য রংপুর লিমিটেড’।গড়ে তুললেন রংপুরের লাহিড়ির হাট, পদাগঞ্জ, পীরগাছা, রাবার্টসনগঞ্জ ও কুড়িগ্রামের উলিপুরে একে একে পাঁচটি কারখানা।
সফিকুল আলম বললেন, ‘শতরঞ্জি এখন রংপুরের ঐতিহ্য নয়, এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্য। রংপুরের অজপাড়াগাঁয়ে শুধু যে হস্তশিল্প শতরঞ্জি তৈরি করে রপ্তানি করছি, তা নয়। এখানকার হতদরিদ্র পরিবারের লোকজন কাজের সুযোগ পেয়েছেন। এখন এই শিল্প বাঁচিয়ে রাখাসহ বিদেশি ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে এই শিল্পের গুণগত মান আরও ভালো করে তুলতে হবে।’
বর্তমানে বাংলাদেশে হস্তশিল্প রপ্তানি আয়ের শতকরা ৬০ ভাগের অবদান কারুপণ্য রংপুর লিমিটেডের। অসাধারণ এই কাজের জন্য ২০১০ সালে সরকারি পর্যায়ে জাতীয় রপ্তানি ট্রফির স্বর্ণপদকের পুরস্কার পান কারুপণ্যের স্বত্বাধিকারী সফিকুল। ২০১২ সালে সরকারের পক্ষ থেকে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (সিআইপি) হিসেবে স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মাননা দেওয়া হয় তাঁকে। এ ছাড়া একই বছর থাইল্যান্ডে ‘আইকেইএ’ নামের গৃহসজ্জার কাজ করা একটি বড় প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাঁকে সম্মানিত করা হয়।
কারুপণ্য ছাড়াও রংপুর নগরের নিসবেতগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় ১২টি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে শতরঞ্জিপল্লি ও চারুশী রয়েছে। এ ছাড়া অর্ডার অনুযায়ী বিভিন্ন বাসাবাড়িতে কাজ করা হয়।
শতরঞ্জিপল্লিতে গিয়ে দেখা যায়, নারী-পুরুষ শতরঞ্জি বুননে ব্যস্ত। শিরিনা বেগম (৩৫) বললেন, ‘দীর্ঘ ১০ বছর থেকে কাজ করছি।’ রংপুর সরকারি কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী মারুফা বেগম দুই বছর থেকে এই কাজের সঙ্গে জড়িত। সে জানায়, পড়াশোনার ফাঁকে এই কাজ করতে বেশ ভালোই লাগছে। এতে কিছু আয় হয়। এই টাকা পড়াশোনার কাজে লাগছে। রাশেদা বেগম (৪০) আট বছর ধরে কাজ করছেন। শতরঞ্জি বুননের টাকায় যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার ভালোভাবেই চলছে। রাজিয়া সুলতানা (২৫), মাছুরা খাতুন (২২), আখিরা খাতুন (২৫), রঞ্জিনা বেগম (৪৫), আজমিয়া বেগম (২৭), মৌসুমী বেগমসহ আরও অনেকেই বললেন, হস্তজাত এই শতরঞ্জিশিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে তাঁদের জীবন-জীবিকা চলছে। প্রতিদিন একজন শ্রমিক ১০ থেকে ১৫ বর্গফুট শতরঞ্জি বুনতে পারেন। প্রতি বর্গফুটে তাঁরা ১৫ টাকা করে মজুরি পেয়ে থাকেন।
শতরঞ্জিপল্লির স্বত্বাধিকারী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। জাপানের একটা অর্ডার পেয়েছি। এর জন্য দিনরাত কাজ চলছে।’ আর চারুশী প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী তহুরা বেগম বলেন, শতরঞ্জি তৈরি করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়।
শতরঞ্জিশিল্পের প্রসারে সরকারের দিক থেকে কী করণীয় আছে, জানতে চাইলে রংপুরে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) মহাব্যবস্থাপক আলতাব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিসিক তাঁতিদের ঋণ-সহায়তা দিয়ে থাকে। কমপক্ষে ৪০ হাজার টাকা করে ৫ শতাংশ সুদে এ ঋণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া এ পর্যন্ত ৬৬০ জন তাঁতিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে বিসিক।’